মারুফুল ইসলামের কবিতা: সাতজনের সংসার

১.

শায়েস্তানগরে আমাদের পাশের বাসায় এক সকালে ওরা এলো
ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটার নাম নাহিন

আমরা তখন তিন ভাই
এক বোন
নাহিনের মাকে আমি খালা ডাকতাম
তিনি সারাদিন খাটে শুয়ে থাকতেন
আমি আর নাহিন খেলতাম
কখনো আমদের বাসায়
কখনো ওদের
দুজনেই তখন পাঁচ


জলরংয়ে আঁকা ফাহমিদা জামান ফ্লোরার চিত্রকর্ম

এক রাতে নাহিনের মার মৃত্যু হলে ওরা চলে গেল
আমাদের আর কখনোই দেখা হয়নি
আম্মাকে বললাম
আমার একটা বোন হলে ওর নাম রাখব
নাহিন

উনিশশো একাত্তর
অক্টোবর
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ
কারফিউ-দেওয়া এক মধ্য রাতে
হঠাৎ আব্বার ডাক
তোমাদের জন্য একটা বোন এনেছি দেখ

খাটে শুয়ে আছে তুলতুলে মোমের পুতুল
মুখে আঙুল
আম্মা একটু হেসে বললেন
নাহিন
সেই থেকে আমরা সাতজন

২.

আম্বরখানায় ইটের টুকরো মেরে ফাটিয়ে দিয়েছিলাম
বড়ভাইয়ের বন্ধু সালামের কপাল
সেই সাড়ে চারে
তারপর তিন মাস তিন তলা থেকে খেলতে নামিনি নিচে
তখন সহচর ছিল চারতলার শংকর

পাশের ফ্ল্যাটের আম্বিয়া মামা ছিলেন
রেডিওর কারিগর
মুগ্ধ হয়ে দেখতাম তার কাজ
আমরা দুজন

তিন মাস পর এক দুপুরে শংকরের প্ররোচনায়
নিচে নেমেই পড়লাম বাঘের মুখে
সামনে সালাম

হাত চেপে ধরে ও আমাকে টেনে নিয়ে চলল
সমান্তরালে চলল শংকরের কাকুতিমিনতি
আমি হতবাক

সেই দুপুরে সালাম আমাদের দুজনকে
দোকান থেকে লজেন্স কিনে খাইয়েছিল
আর দুগাল হেসে দেখিয়েছিল
কপালের দাগ

৩.

সুরাইয়া আমাদের সাথে খেলত
ওর বাবা আম্বরখানা কলোনির পানির পাম্পমেশিন চালাতেন
আমাদের দেখলেই ডেকে ডেকে খাওয়াতেন
মালাই আইসক্রিম
নাহলে লাঠিলজেন্স
মেশিনঘরটা আমাকে খুব কাছে টানত

এক বিকেলে খেলছি
সুরাইয়ার বাবা এসে মেশিন ছাড়লেন
আমরা চারপাশে ঘুরঘুর
আইসক্রিমওয়ালা নেই
অগত্যা লাঠিলজেন্স
একটু পরে চলে গেলেন তিনি মেশিনঘরে তালা দিয়ে

খেলাশেষে বাড়ি ফিরে হাতপা ধুয়ে দোতলার বারান্দায়
আম্মা ভাত রাঁধছেন
হঠাৎ চলমান আলো কলোনির দিকে বেঁকে এল
অত:পর শব্দ
তারপর একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল কলোনির মধ্যখানে

নেমে এল একটা লাশ
সুরাইয়ার বাবার
সকলেই হতবাক
চিৎকৃত আকুল কান্নায় আছড়ে পড়ে এক অকূল পরিবার

বিকেলেও ছিলেন
অথচ সন্ধেয় নেই
মৃত্যু এত কাছে
এত সহজ
আম্বরখানার সেই মেশিনঘর আমাকে আর কাছে টানেনি

৪.

এরোপ্লেন প্রথম দেখেছি সিলেট বিমানবন্দরে
শর্মাকাকুর গাড়িতে চড়ে আমরা ভাইবোনরা গিয়েছিলাম
এক বিকেলে
নিজেই চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন
আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তা ধরে টিলার পাশ দিয়ে
আব্বাআম্মাও ছিলেন

অপলক তাকিয়ে আছি
আচমকা আকাশের নীল থেকে
উড়ন্ত বাহন তীরবেগে নেমে এসে ছুটে গেল
রানওয়ে বরাবর চোখের পলকে
ফুঁসে ওঠা গর্জনে সচকিত বাতাস
আবার যখন ডানা মেলে উড়ে গেল শূন্যের আড়ালে
তখন এক নি:শব্দ হাওয়া অগোচরে ছুঁয়ে গিয়েছিল
চমকিত শিশুর হৃদয়

উড়তে পারে না মানুষ
তবু কতকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়

৫.

এক থালা চিঁড়ে মাঠায় মাখামাখি
তার ওপর মাখনের ছোট্ট দলা
দুটো চাঁপা কলা
দু-তিন টুকরো গুড়
বেহেশতের ফেরেশতারা লোভাতুর চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশেষ প্রাতরাশ
মানুষ তো কোন ছার

মামার বিয়েতে গিয়ে নানার বাড়িতে জীবনে প্রথম এই আস্বাদ পাই
আর প্রথম টের পাই চাপ চাপ বুকে
নানাবাড়ি গেলে আম্মা কেমন যেন আর পুরোপুরি মা থাকতেন না
অনেকখানি মেয়ে হয়ে যেতেন

৬.

পৈল গ্রামে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম একাত্তরে
পুরনো একটা জমিদার বাড়ির চারটে ঘরে
থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল চারটে পরিবারের

সারা দিন ছুটোছুটি লুটোপুটি হুল্লোড়
রাতে চুপিচুপি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র
এ-ঘরের চায়ের সঙ্গে মিশে যেত
ও-ঘরের চিনি
যুদ্ধ শত্রুকে ছিন্ন করে
মিত্রকে যুক্ত

৭.

একবারই শুধু দেখেছি
বড়ভাই আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ
সেই বাহাত্তরে
হবিগঞ্জ স্টেডিয়ামে

সে কী ভিড়
সে কী উত্তাল জনজোয়ার
মানুষের সে কী উন্মাদনা
স্বাধীন দেশের স্বাধীন জাতির স্বপ্নপুরুষ
এসে দাঁড়ালেন চোখের সামনে
সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ
এ কী রূপ
এ কী কণ্ঠ
এ কী ব্যক্তিত্ব

তারপর বাড়ি ফিরে আম্মার কাছে আমার বর্ণনা আর ফুরোয় না
আব্বাও ছিলেন সেই সমাবেশে
কে না ছিল

পঁচাত্তরে আম্মা বিশ্বাস করেননি বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার খবর
বিশ্বাস করলেন সেদিন
যেদিন পিতৃহারা কন্যা ফিরে এলেন স্বদেশে

৮.

বর্ষায় কই মাছের সঙ্গে ডাঙায় উঠে আসত ঢোঁড়াসাপ
বারান্দায় পাঁচ ভাইবোন মিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
সাপের ব্যাঙগেলা কত দেখেছি
একবার গোসলখানায় ঢুকে গেল ইয়া বড় এক ঢোঁড়া
কিছুতেই যাচ্ছিল না
শেষমেষ আম্মা, বড়ভাই আর আমি তিনজন মিলে দফারফা করেছি

এখন সাপের ভয়ে আমি অন্ধকার বা নির্জন রাস্তায় হাঁটি না
এমনকি পানিতেও নামি না

আর ছিল জোঁক
ছোট দুভাইবোন পুকুরে নামত না ভয়ে
উঠোনে দেখলে দৌড়ে এসে খাটে উঠে পা গুটিয়ে বসে থাকত জড়সড়
আম্মা জোঁকের গায়ে ছেড়ে দিত নুন
বড়ভাই আর আমি আঙুল বাড়িয়ে দিতাম জোঁকের মুখে
লকলক করে উঠে এলে ছিঁড়ে ফেলতাম দুহাতের চার আঙুলে চেপে ঘরে টেনে টেনে

এখন সকালে হ্রদের পারে কুকুর কিংবা জোঁক দেখলে ঘুরপথে হাঁটা ধরি

মানুষ যত বেশি বাঁচতে থাকে
তত বেশি মরতে থাকে

৯.

শৈশবে আর কৈশোরে কোরবানির ঈদ মানেই রেলগাড়ি চড়ে দাদুবাড়ি
এই ভ্রমণের সাথে আর কিছুই লাগে না
দাদুবাড়ির তিনটে বাড়ির পরে মোক্তার নানার বাড়ি
ওঁর দু নাতনির বড়টা আমার সমান
ছোটটা হাঁটতে শিখেছে
একদম ফেরেশতা একটা

এক ঈদের আগের বিকেলে গরু কেনা সারা দু বাড়িতেই
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে
সন্ধে গড়িয়ে রাত
খেলাশেষে খাওয়াশেষে ঘুম
ঘুম ভেঙে ঈদ

কিন্তু সবাই কেন থমথমে মুখে মোক্তার নানার বাড়ি যায়
সকলের চোখ কেন ছলছল
পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াই
ও-বাড়ির উঠোনে
আহা ঈদের সকালে ছোট্ট ফেরেশতাটা চোখ বুজে ঘুমিয়ে আছে
ধবধবে বিছানায়
পাশে একটা কচি লেবু

ঘুম থেকে জেগে এলোমেলো পায়ে
কচি লেবুটা ধুয়ে আনতে গিয়েছিল পুকুরের ঘাটে একা
উৎসবের একবাড়ি চোখের অগোচরে

কেনা গরু বাঁধা ছিল গাছে
কিন্তু সেবার ওদের বাড়িতে আর কোনো কোরবানি হয়নি


জলরংয়ে আঁকা ফাহমিদা জামান ফ্লোরার চিত্রকর্ম

১০.

একটা থালায় ভাত খাচ্ছিল ওরা দুজন
একটা ন্যাংটো এইটুকু ছোট্ট মেয়ে
আর একটা আধ ন্যাংটো মা
বড় রাস্তার ধার ঘেঁষে
ইটের স্তূপের পাশে বেঁকে পড়া ছায়ায় বসে
থেকে থেকে ছুটে যাচ্ছে মালবাহী ট্রাক
মাঝেমধ্যে দুয়েকটা যাত্রীবাহী বাস
ক্লান্ত রিকশা আর অক্লান্ত পথচারীর চলাচল অবিরল অবিচল

কচি বাচ্চাটার মুখে এক নলা ভাত তুলে দিচ্ছিল মা
নিজের মুখে তুলে নিচ্ছিল পরের নলা
ভাত মানে ভাত
শুধু ভাত
সাদা ভাত
আবছা সাদা
এক চিমটি লবনও ছিল না

অদূরে দুপুরের গরমে
জিব বার করে হাঁপাচ্ছিল
রোঁয়া ওঠা হাড় জিরজিরে তিনটে কুকুর
এপাশে একটু দূরে আমরা পাঁচ ভাইবোন

শিশুটাকে শেষবার খাবার দিয়ে
মা শেষ নলাটা মুখে পুরেছে কি পোরেনি
ও বলে উঠল, আরও ভাত খাব,মা
শিশুটার মুখ খালি
শিশুটার পেট খালি
শিশুটার বুক খালি
শিশুটার সারা গা খালি
ভাতের থালা খালি
মায়ের হাত খালি
মায়ের পেট খালি
মায়ের মুখে কেবল এক নলা ভাত অবশিষ্ট

আধ চিবোনো ভাত নিজ মুখ থেকে বার করে
মা তুলে দিল মেয়ের মুখে
মায়ের চোখে জল
মেয়ের মুখে ভাত
মায়ের বুকে মেয়ে

বেঁচে থাকা এত কষ্টের
বেঁচে থাকা এত আনন্দের

১১.

ইশকুল-ছুটির দিনে ছানাবাটি
তারপর দুলাল সিনেমা হল
কিংবা সুরতমহল
জালালিয়ার সিঙ্গারা
বিসমিল্লাহর চপ
বিমূর্ত এই রাত্রি আমার

বিরতিতে চানাচুর
আগে-পরে ক্যাপস্টেন
তিনঘন্টার ভালোলাগা রাতভর ঘুমের ভেতর
তুমি যে আমার কবিতা

ছুটির দিনের ছন্দ আর ছুটি দেয়নি আমাকে
আব্বার আপত্তিও আটকে গেল অন্ত্যমিলে

কবিতা তখন ক্লাস নাইনে পড়ত
চন্দনা নামে

১২.

খেলার মাঠের এক পাশ দিয়ে
প্রতিদিন শেষবিকেলে তেলের শিশি হাতে
পাড়ার মুদির দোকানে হেঁটে যেত প্রতিমা
একটু পরেই ঘরে জ্বলে উঠবে সন্ধেবাতি
বাহাদুর খেলুড়েদের জোড়া জোড়া চোখ ফুটবল ছেড়ে
অপলক ঘুরে যেত সেই দিকে
মাঠ বুঝি খানিকটা হেলে পড়ত
কে শোনে রেফারির বাঁশি

ওর তখন পনের-ষোলো
আমাদেরও
ওর বাবার হোমিওপ্যাথি অষুধের চাইতে মিষ্টি কিছু
ত্রিভুবনে ছিল না সেসময়

মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই
আকাশবাতাস চিরে বেজে উঠল সানাই
জীবনে প্রতিমা বিসর্জন
হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা

১৩.

আমাদের মফসসলে হঠাৎ ফুল ফুটল সূর্যমুখি
দুলাল সিনেমা হলে সানফ্লাওয়ার
ম্যাটিনিতে ব্ল্যাকে টিকিট কেটে আমরা দুভাই ব্যালকনিতে
পাশের সিটে বিমানদা, মনে পড়ে
গরমের অপরাহ্ণে তৃষ্ণার্ত বিরতিতে
সে আমাদের খাইয়েছিল কোকাকোলা
অবশ্য ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল তার
সেটা জেনেছি পরে

প্রেক্ষাগৃহের আলোঅন্ধকারে
জীবনে প্রথম বিদেশি বিভাষী চলচ্চিত্রের যতটুকু বুঝেছি
তার চাইতে না-বোঝার পাল্লা ছিল ভারী
তবে মুগ্ধতা পুরোপুরি

আর কেন জানি আমি শুধু
আম্মার সঙ্গে সোফিয়া লরেনের মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম

১৪.

বাসে চড়লেই বমি পেত আমার ছোটবেলায়
ভালো লাগত রেলগাড়ি
ভালো লাগত রেলস্টেশন
অবিরাম উৎসব

রেললাইন ধরে অনেক হেঁটেছি
কখনো নি:সঙ্গ
কখনো সসঙ্গ
লাইনে কান পেতে শুনেছি দূরাগত ট্রেনের আওয়াজ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ট্রেন ছেড়ে গেছে সিলেটে
সিলেটের রেলগাড়ি হবিগঞ্জে
হবিগঞ্জ থেকে ফেনী
আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকা
সাতজনের ক্রমাগত ধাবমান সংসার

১৫.

জীবনযাপন করা ছাড়া আব্বার আর কোনো শখ চোখে পড়েনি
আম্মার শখ ছিল সংসারের শ্রীবৃদ্ধিসাধন
আপার অভিনয়
বড়ভাইয়ের খেলাধুলো
আমার ছবি আঁকা
ছোটভাইয়ের গান
ছোটবোনের লেখালেখি

আব্বা জীবনের লেনদেন চুকিয়েছেন দুই যুগ আগে
আম্মা প্রার্থনায় সমর্পিত
আপার অবসর কাটে টেলিভিশন দেখে
বড়ভাই ব্যবসা ছাড়া এখন
আর কিছু বোঝে বলে মালুম হয় না
ছোটভাই মরজগতের বিভ্রমে বিভ্রান্ত না হয়ে
পরজগতের বিনিয়োগে উদয়াস্ত ব্যস্ত
একমাত্র সন্তান ব্যতীত ছোটবোনের অন্য কোনো দুনিয়া নেই
আর আমি
থাক
সাত জনের সংসার বদলায় বাঁক

মারুফুল ইসলাম

Top